ভূমিকা
আধুনিক বিশ্বে শিল্পায়নের ধারণা ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। মানুষের পরিধানের জন্য কাপড় উৎপাদন একসময় শিল্প হিসেবে পরিচিত ছিল। আজ পোশাক শিল্প অনেক দেশে শিল্পায়নে নতুন সম্ভাবনা তৈরি করেছে। এই সম্ভাবনার সংযোজনও ঘটেছে আমাদের বাংলাদেশে। বাংলাদেশ বর্তমানে বিদেশে পোশাক রপ্তানি করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে। বস্তুত, পোশাক শিল্প জাতীয় আয়ের প্রায় ৬৪ শতাংশ জোগান দেয়। তাছাড়া এই শিল্প অনেক বেকারের কর্মসংস্থান করেছে। তাদের অধিকাংশই নারী। এর ফলে একদিকে যেমন অর্থায়ন ও নারীর ক্ষমতায়নের কিছু সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে, অন্যদিকে তারা পুরুষ নির্যাতন থেকেও রক্ষা পাচ্ছে। পোশাক শিল্পের উদ্যোক্তাদের দ্বারা শোষিত হলেও সামগ্রিকভাবে এই শিল্প আমাদের দেশের সামাজিক ও অর্থনৈতিক দিক দিয়ে অত্যন্ত ইতিবাচক ভূমিকা পালন করছে।
বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের অতীত অবস্থা
সুদূর অতীত থেকেই বিশ্ববাজারে বাঙালি পোশাক শিল্পের যথেষ্ট চাহিদা ছিল। বিশেষ করে মসলিন ও জামদানি নামক সূক্ষ্ম কাপড় বিশ্ব বিখ্যাত ছিল। কিন্তু ব্রিটিশদের আগমনে পোশাক শিল্প অনেকাংশে ধ্বংস হয়ে যায়। তারা তাঁত শিল্পকে ধ্বংস করার নানা পরিকল্পনা করে। তারা কাপড়ের বাজার তৈরি করতে মেশিনের মাধ্যমে কাপড় তৈরি শুরু করে। ফলে এক পর্যায়ে পোশাক শিল্প তার নিজস্ব স্বকীয়তা হারাতে থাকে।
বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের বর্তমান অবস্থা
দীর্ঘ যাত্রার পর বাংলাদেশ তার তৈরি পোশাক শিল্পের মাধ্যমে বস্ত্র খাতে তার হারানো গৌরব ফিরে পেতে চাইছে। এই শিল্প দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে একটি উৎসাহব্যঞ্জক অবদান রেখে চলেছে। কিন্তু বস্ত্র খাতের হারানো গৌরব পুনরুদ্ধারের ইতিহাস খুব বেশি দিনের নয়। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ কিছু শিল্প পণ্য বিদেশে রপ্তানি শুরু করে। 1977 সালে, বেসরকারী শিল্প উদ্যোক্তাদের সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত প্রচেষ্টার মাধ্যমে বাংলাদেশে পোশাক শিল্পের বিকাশ ঘটে। তখন মাত্র কয়েকটি শিল্প প্রতিষ্ঠান ছিল।
1985 সালে, তৈরি পোশাক শিল্প ব্যাপক সম্প্রসারণের অভিজ্ঞতা লাভ করে। শুরুতে ১৫০টি পোশাক কারখানা ছিল। এই সীমিত সংখ্যক কারখানা দিয়ে পোশাক শিল্পের সূচনা হলেও শিল্পপতিরা ধীরে ধীরে কারখানার সংখ্যা ও শ্রমিকের সংখ্যা বাড়ান। দেশীয় উদ্যোক্তাদের সক্রিয় ভূমিকার কারণে এসব শিল্পের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে তিন হাজারের বেশি। এসব প্রতিষ্ঠানে প্রায় ১.৮ লাখ লোক কর্মরত, যার মধ্যে নারী শ্রমিকের সংখ্যা বেশি, প্রায় ৮৫%।
পোশাক শিল্পের ইতিহাস
জীবনধারণের জন্য যেমন খাদ্যের প্রয়োজন, তেমনি সমাজে বসবাসের জন্য মানুষের বস্ত্রের প্রয়োজন। প্রাচীনকালে, লোকেরা লতা, পাতা, বাকল এবং পশুর চামড়া দিয়ে তাদের বস্ত্রের চাহিদা মেটাত এবং পরবর্তীতে তন্তু, সুতা এবং কাপড় ধীরে ধীরে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। কবে, কবে এবং কোথায় প্রথম কাপড়ের ব্যবহার শুরু হয়েছিল তা সঠিকভাবে জানা না গেলেও এক সময় মানুষ সুই সুতো দিয়ে সেলাই করে নিজেদের পোশাক তৈরি করত। ধীরে ধীরে মানুষ সেলাই মেশিনের সাহায্যে কাপড় তৈরি করতে থাকে। মানুষ সেলাই মেশিনের সাহায্যে কাপড় সেলাইয়ের ইতিহাস মাত্র 260 বছরের গল্প। সেলাই মেশিন উদ্ভাবকদের প্রাথমিক ইতিহাস দেখায় যে ইংল্যান্ডের চার্লস ফ্রেডরিক 1755 সালে প্রথম যান্ত্রিক সেলাই মেশিন আবিষ্কার করেন। তারপর সেলাই মেশিন হাত সেলাইয়ের মতো সেলাই তৈরি করতে পারে। আইজ্যাক মেরিট সিঙ্গার 1851 সালে বাণিজ্যিকভাবে সফল সেলাই মেশিন আবিষ্কার করেছিলেন।
বাংলাদেশের পোশাক শিল্প এবং এর ভবিষ্যৎ
বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের যাত্রা শুরু হয় ষাটের দশকে। বর্তমানে এটি বাংলাদেশের বৃহত্তম রপ্তানিমুখী শিল্প। 1960 সালে, বাংলাদেশের প্রথম পোশাকটি ঢাকার উর্দু রোডে রিয়াজ স্টোর নামে যাত্রা শুরু করে। 1967 সালে, রিয়াজ স্টোরের উৎপাদিত 10,000 পিস শার্ট প্রথমবারের মতো বাংলাদেশ থেকে দেশের বাইরে (যুক্তরাজ্য) রপ্তানি করা হয়েছিল। এরপর 1973 সালে তিনি “রিয়াজ স্টোর” এর নাম পরিবর্তন করে “রিয়াজ গার্মেন্টস” করেন। এছাড়া এ যুগের আরও একটি পোশাকের কথা শোনা যায়, তা হলো ‘দেশ গার্মেন্টস’। দেশ গার্মেন্টস ছিল 100% রপ্তানিমুখী পোশাক। সেখানে 9টি রপ্তানিমুখী কোম্পানি প্রতি বছর 10 মিলিয়ন মার্কিন ডলারের ব্যবসা করে। সে সময় দেশে বড় ও বিখ্যাত পোশাক কারখানা ছিল ৩টি। তারা হলেন- রিয়াজ গার্মেন্টস, জুয়েল গার্মেন্টস।
পোশাক শিল্পের বাজার
যেকোনো উৎপাদনের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো পণ্যের বাজার তৈরি করা। তা না হলে পণ্য যতই ভালো হোক না কেন, তা কোনো কাজে আসে না। আশার কথা, বাংলাদেশের পোশাক শিল্প বিশ্ববাজারে যথেষ্ট চাহিদা তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে। আমাদের তৈরি পোশাকের প্রধান বাজার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্রে পোশাক রপ্তানিতে বাংলাদেশের অবস্থান পঞ্চম। বাংলাদেশ কানাডা, ইইসি দেশ, জাপান, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, ফ্রান্স, জার্মানি, বেলজিয়াম এবং মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে 23টি দেশে পোশাক রপ্তানি করে। এসব পোশাকের মধ্যে রয়েছে শার্ট, পায়জামা, জিন্স প্যান্ট, জ্যাকেট, ল্যাবরেটরি কোট, গেঞ্জি, সোয়েটার, পুল ওভার, খেলাধুলার পোশাক, নাইট ড্রেস ইত্যাদি। বর্তমানে বাংলাদেশের পোশাকের বাজার বিভিন্ন দেশে বিস্তৃত হচ্ছে।
বাংলাদেশের অর্থনীতিতে পোশাক শিল্পের অবদান
পোশাক শিল্প বাংলাদেশের অর্থনীতিতে সুদূরপ্রসারী অবদান রেখে চলেছে। এই সেক্টরের অবদানের প্রধান দিকগুলি নিম্নরূপ:
অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং রপ্তানি বৃদ্ধি
পোশাক শিল্পের বিকাশের সাথে সাথে দেশের রপ্তানি পণ্যের সংখ্যা বেড়েছে। আমাদের দেশের প্রায় শতাধিক বায়িং হাউস কাপড় কেনা-বেচায় নিয়োজিত রয়েছে। জাতীয় আয়ের প্রায় ৬৪% আসে এই খাত থেকে। তবে এই আয় নির্ভর করে রপ্তানি বাণিজ্যের ওপর।
বেকার সমস্যা সমাধান
এই শিল্প বেকারত্ব নিরসনে এবং জাতীয় জীবনে স্বনির্ভরতার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে কারণ এই খাতে দরিদ্র, নিম্ন ও মধ্যবিত্ত পরিবারের ১০ লাখেরও বেশি নারী শ্রমিককে কর্মসংস্থান করা যেতে পারে।
দ্রুত শিল্পায়ন
পোশাক শিল্প দ্রুত শিল্পায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। ফলে এদেশে বিভিন্ন স্পিনিং, উইভিং, নিটিং, ডাইং, ফিনিশিং, প্রিন্টিং ইত্যাদি শিল্প গড়ে উঠছে। এ ছাড়া গার্মেন্টস, জিপার, বাটাম, বগলা ইত্যাদি শিল্পের প্রসার ঘটছে।
পরিবহন এবং পোর্ট ব্যবহার
পোশাক শিল্পের আমদানি-রপ্তানি বন্দর থেকে কারখানায় পরিবহণ শিল্পের অগ্রগতি এবং তাদের যথাযথ ব্যবহারের দিকে নিয়ে গেছে।
অন্যান্য অবদান
পোশাক শিল্পে বিনিয়োগ করে ব্যাংকগুলো লাভবান হচ্ছে। বীমা কোম্পানির প্রিমিয়াম বাড়ছে। বাংলাদেশে আসছে নতুন প্রযুক্তি।
ফ্যাশন শিল্পে সমস্যা
1 জানুয়ারী, 2005 থেকে, বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা (WTO) দ্বারা প্রবর্তিত টেক্সটাইল এবং পোশাক সংক্রান্ত চুক্তি কার্যকর হয়। মাল্টিফাইবার অ্যারেঞ্জমেন্ট (MFA) চুক্তি বাতিল করা হয়েছে। ফলে কোটা সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়ে কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে পোশাক শিল্প। আসলে আমাদের দেশ কোটামুক্ত বিশ্ববাজারে প্রতিযোগিতার জন্য প্রয়োজনীয় সব প্রস্তুতি এখনো করেনি। যেখানে সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, চীন, ইন্দোনেশিয়া প্রভৃতি দেশ কম খরচে মানসম্মত পোশাক উৎপাদন করছে, সেখানে বাংলাদেশ এখনো অনেক পিছিয়ে। এই পশ্চাৎপদতার মূলে রয়েছে নানা সমস্যা।
গার্মেন্টস শিল্পের সম্ভাবনা
বাংলাদেশের বস্ত্র শিল্পের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল। কিন্তু আজকের প্রতিযোগিতামূলক বাজারে। বাংলাদেশের পোশাক শিল্পকে টিকে থাকতে অনেক দূর যেতে হবে। এর জন্য আমাদের প্রস্তুতি নিতে হবে। শিল্প প্রতিষ্ঠানের ISO সার্টিফিকেশন গ্রহণ করা উচিত। ক্রেতারা যেহেতু বিষয়টিকে গুরুত্ব দিচ্ছেন। সর্বোপরি, আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে আমাদের টেক্সটাইল ও পোশাকের গুণগত মান উন্নয়ন, দক্ষতা বৃদ্ধি এবং দাম কমানোর মাধ্যমে চ্যালেঞ্জটিকে সুযোগ হিসেবে নিতে হবে। সে লক্ষ্যে সরকার, উদ্যোক্তা ও ব্যাংকগুলোকে এগিয়ে আসতে হবে।
বাংলাদেশে পোশাক শিল্পের অবস্থান
2021 সালের শেষ নাগাদ, বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানি তার প্রধান পোশাক রপ্তানি প্রতিদ্বন্দ্বী ভিয়েতনামের তুলনায় $4.72 বিলিয়নে বেড়েছে। ফলে পোশাক রপ্তানিতে ভিয়েতনামকে টপকে দ্বিতীয় স্থান অর্জন করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। 2021 সালে, বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক বাজারে 3,580 মিলিয়ন ডলার মূল্যের তৈরি পোশাক রপ্তানি করেছে। একই সময়ে পোশাক শিল্পের বিশ্ব বাণিজ্যে বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান প্রতিযোগী ভিয়েতনামের রপ্তানি মূল্য ছিল তিন হাজার। 108 মিলিয়ন ডলার। তৈরি পোশাক রপ্তানিতে বিশ্বে চীনের অবস্থান প্রথম। আর বাংলাদেশের এক ধাপ নিচে অর্থাৎ প্রধান প্রতিযোগী দেশ ভিয়েতনাম উঠে গেছে তৃতীয় স্থানে।
উপসংহার
মূল্যবান বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন এবং দেশের বেকারত্ব সমস্যা সমাধানে পোশাক শিল্পের ভূমিকা অনন্য। বাংলাদেশের পোশাক শিল্প 1977 সালে মুষ্টিমেয় কিছু কারখানা দিয়ে শুরু হয়েছিল, আজ এর সংখ্যা বহুগুণ বেড়েছে। জাতীয় আয়ের পাঁচ শতাংশের বেশি আসছে এ শিল্প থেকে। তাই এটা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে এই শিল্প আরও সমৃদ্ধ হবে এবং সর্বক্ষেত্রে সরকারি অনুগ্রহে বাংলাদেশের জন্য সীমাহীন সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দেবে। আর পোশাক শিল্প ভবিষ্যতে আরও আধুনিক হয়ে উঠবে।
No Comments